কে উনি pdf | মোহাম্মদ তোহা আকবর

 



 সম্মানিত পরিবারের ব্যক্তিত্ববান আর রুচিশীল কাউকে দেখেছ কখনো? না দেখলে কল্পনা করে নাও এমন কোন পরিচিত স্নেহময় উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ববান মুখ। চল্লিশোর্ধ্ব সহানুভূতিশীল একটা মানুষকে সবার সামনে মৃত উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে হেনস্থা হবার কল্পনা যে তোমাকে করতেই হবে। অন্তত নিজেকে যে সে জায়গায় ভাবতেই হবে, নইলে কোনদিনও বুঝবে না, অনুভব করতে পারবে না এই সত্যের দাম। যে দাম আমার প্রিয় নবিজিকে সা. দিতে হয়েছে নিজের এলাকা আর গোত্রবাসীদের দিবানিশি অত্যাচার আর নির্বাসনের যন্ত্রণা মেনে নিয়ে।”

....


কিছু কিছু বই থাকে পড়তে গিয়ে বারবার ইচ্ছে করে লাইনগুলো সকলের সামনে তুলে ধরি। বইয়ের একেকটা লাইন মনের ভেতর যে অসম্ভব জোরে গিয়ে বিঁধেছে, উথাল-পাথাল ঢেউ সৃষ্টি করেছে, চিন্তাজগতে ঝড় তুলেছে সেই অনুভূতিও সবাইকে জানাই। এই বইটাও সেরকম। লেখকের লেখার মুন্সিয়ানার সাথে যারা আগে থেকেই পরিচিত তারা নিশ্চয়ই জানেন, উনার লেখা একেকটা লাইন কীভাবে ভাবতে শেখায়, ভাবাতে সাহায্য করে, চিন্তার এক নতুন দুয়ার খুলে দেয়। এই বইটাও তার ব্যতিক্রম না। তাছাড়া এ ধরণের বইয়ের ব্যাপারে এক লাইন রিভিউ দিলেই যথেষ্ট। 'বইটা আমার রাসূল সা.কে নিয়ে লেখা।'


বইয়ের মূল চরিত্রের একজন হৃদয় কুমার। নামের শেষে জুড়ে দেয়া 'কুমার' দেখেই আন্দাজ করে নেয়া যায় মানুষটা হিন্দু। বছর কয়েক আগে নাস্তিক থাকলেও বর্তমানে স্রষ্টার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। তবে হৃদয় এখন খুঁজে চলেছে একজন মানুষের পরিচয়। না, তার ব্যক্তিপরিচয় নয় বরং নবুওয়াতি পরিচয়। মনে উদিত হওয়া হাজার হাজার প্রশ্ন আবর্তিত হয়েছে সেই মানুষটিকে ঘিরেই। 'কে এই মুহাম্মাদ সা.? সত্যিই কি তার দাবি অনুযায়ী তিনি একজন নবী ছিলেন? কীভাবে এই দেড় হাজার বছর পরেও আমি নির্দ্বিধায় বুঝে নিতে পারব, যে তিনি মিথ্যে বলেননি? অথবা তিনি নিজেই বিভ্রান্ত ছিলেন না?' অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী হৃদয় মনে মনে প্রস্তুত হয়, সত্যের পথ যত কঠিনই হোক, যত তেতোই হোক না কেন, সেই তিক্ততা আর কাঠিন্যকে অতিক্রম করে সত্যকে সে বুঝে নিবে, বোঝার পর মেনে নেবে।


ইতিহাসের পাঠ হৃদয় কুমারের সামনে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে— মুহাম্মাদ নামের এই অনক্ষর আনপড় মানুষটা আসলে কে? কীভাবে সেই রুক্ষ মরুতে শান্ত আর কোমল বাতাসের এমন সুন্দর এক ঝড় তুললেন স্মিত হাসির অধিকারী এই মানুষটা? প্রায় দেড় হাজার বছর পরেও হৃদয় কুমারের মানসে-অনুভবে সেই ঝড়ের ঝাপ্টা এসে লাগছে বারবার! আসলেই তো, কে উনি?


বইয়ের আরেকটা শক্তিশালী চরিত্র 'ভাইয়া।' ভাইয়া বিশ্বাসী মুসলিম। হৃদয়ের আপন মায়ের পেটের বড় ভাই না হলেও পেটের নাড়িভুড়ির সবকিছু এই ভাইয়াকে এসেই বলে। তবে ভাইয়া কখনো নিজের মত, নিজের বিশ্বাস হৃদয়ের উপর চাপিয়ে দেয়নি। বরঞ্চ হৃদয়কে ভাবাতে শিখিয়েছে, ভাবতে সাহায্য করেছে। হৃদয় আজও ছুটে এসেছে ভাইয়ার কাছে। মনের মাঝে উদিত হওয়া সব প্রশ্নের মরণজট ছাড়াতে চায় সে। ভাইয়া বলে চলে। হৃদয় তন্ময় হয়ে শোনে..


রিভিউর এই পর্যায়ে এসে আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, এ তো সাধারণ প্লটের গল্প। ব্যতিক্রম কিছুই না। বা মনেও হতে পারে, নির্ঘাত ফিলোসোফি আর ভারি ভারি রিসার্চ পেপারের কঠিন সব যুক্তি আওড়ে বিশ্লেষণ করেছে। এই রে! ভুলটা তবে এখানেই করলেন! না, এই ধরণের কোন আলাপ-আলোচনার বা একেবারে সাধারণ মানের কোন বই নয় এটা। বরং মানবীয় বুদ্ধি বা কমসেন্স দিয়েই লেখক বুঝিয়েছেন, সত্য কী। পাঠকের মস্তিষ্কে দিয়েছেন একের পর এক ভাবনার খোরাক। চিন্তার অতল গহব্বরে নিপতিত করেছেন পাঠক-পাঠিকাকে। বইয়ে সুদৃঢ় এবং সুপ্রতিষ্ঠিত ইতিহাস থেকেই একের পর এক প্রমাণ করেছেন, রাসূল সা. একজন নবী ছিলেন। সত্য নবী।


সীরাহের একেকটা ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন নবুওয়াতের সত্যতা। আগাগোড়া সীরাহ না পড়ে থাকা পাঠককেও ধারণা দিয়েছেন রাসূল সা. এর জীবনী সম্পর্কে। পাশাপাশি রাসূল সা. এর চারিত্রিক গুণাবলি, আমানাতদারীতা, বিনয়, উম্মতের প্রতি ভালোবাসা, চরম দূর্যোগে সবার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা প্রতিটি জিনিস এত সুন্দরভাবে আর সুনিপুণ লেখনীতে লেখা যে পড়তে গিয়ে বারবার থমকে গেছি, থেমেছি। হৃদয়ের পোড়া চোখের মতো আমার চোখও পুড়েছে। শুধুমাত্র নাস্তিক বা সংশয়বাদী হলেই যে বইটা পড়তে হবে তা নয় বরঞ্চ আমি বিশ্বাসী পাঠকদের জন্যও বলব, বইটা মাস্টারপিস। বলুন তো কে চায় না রাসূল সা.কে নিয়ে জানতে?


'Some Fulfilled Prophecies of Last True Prophet' ভাইয়ার ডায়েরির এই চ্যাপ্টারটা অসাধারণ লেগেছে। অনেক জানা-অজানা হাদীস আর ঘটনার সাথে পরিচিত হতে পেরেছি। পাঠকের সুবিধার্থে উল্লেখ করি, ১৮টা হাদিস আর ঘটনা নিয়ে শুধু এই চ্যাপ্টারটাই সাজানো হয়েছে। সেইসব প্রফেসি সত্য হওয়ার চাক্ষুষ সাক্ষী সাহাবারা রা. হয়েছেন, আমরা হচ্ছি এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মরাও হবে৷


হৃদয়ের প্রতি লেখা চিঠিতে রাসূল সা. এর সীরাহ বিশ্লেষণ করে একের পর এক পয়েন্ট তুলে ধরা হয়েছে। আরো সহজ করে বলতে গেলে লেখক যেন সবটুকু উজাড় করে দিয়ে লিখেছেন। একেবারেই কার্পণ্য করেননি। সে আপনি পড়তে গেলে বারবার অনুধাবন করতে পারবেন। আর লেখকের হয়ে বইয়ে এই কাজটা করেছে হৃদয় কুমারের ভাইয়া। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই ভাইয়া লেখক নিজেই। আর বাস্তব দুনিয়াতেও হৃদয় কুমারের অস্তিত্ব আছে।


অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। 'যদি রাসূল সা. মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে থাকেন?' কী আশ্চর্য! যে মানুষটা একাধারে আল্লাহ তা'আলার বার্তাবাহক, নেতা, সেনাপতি, বিচারক, অর্থনীতিবিদ, সংবিধান প্রণয়নকারী এমনকি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি দুনিয়ার বুকেই সর্বশ্রেষ্ঠ সফলতা অর্জন করেছেন। ইতিহাস ঘাটলে যেখানে দেখা যায়, পারিবারিক জীবন থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা, যুদ্ধের ময়দান থেকে শুরু করে অর্থনীতিতে প্র‍্যাকটিকাল অবদান, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতি- সব সেক্টরেই উনি সমানতালে এক্সিলেন্স দেখিয়েছেন। জীবিত থাকাকালীন সাহাবারা যার কথায় নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতেও দ্বিতীয়বার ভাবেননি, মৃত্যুর পরেও উনার স্ত্রী-সন্তান, সাহাবা রা. থেকে শুরু করে আজ অবধি লাখ লাখ মানুষ উনার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করে গেছেন আর আজ তাঁর ব্যাপারেই লোকে হাস্যকর সব প্রশ্ন উত্থাপন করে। আফসোস! অথচ তাঁর মতো মেধাবী, সুপারস্মার্ট আর ক্যারিশমাটিক মানুষ আর আসেনি এবং আসবেও না। 

এই চ্যাপ্টারটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।৷ রাসূল সা. এর রাজনৈতিক জীবন থেকে শুরু করে পার্সোনাল লাইফ, লেনদেন, সমরনীতি সহ প্রতিটা জিনিস খুব সুন্দর করে বর্ণনা আর ব্যাখ্যা করা হয়েছে।


নবিজি সাল্লাল্লহু আলাইহিস সালাম তাঁর পুরো জিন্দেগী সত্যের অবিচল অনুসারীদের জন্য, মানুষকে অনন্ত অথৈ মহাশাস্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য উৎসর্গ করেছেনই, এমনকি মৃত্যুর মূহুর্তেও যিনি নিজের কথা ভাবেননি, ভেবেছেন সত্যানুরাগীদের কথা, যারা যুগে যুগে অত্যাচারিত হয়েছে, হবে, কেবল সত্যকে অনুসরণ করার কারণে। যাকে দিয়ে বলানো একেকটা কথা আজও একের পর এক সত্য হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে, যেন মানুষ খেয়াল করে, বুঝতে পারে, ফিরে আসে সত্যের দিকে, সত্যের পথে। তবুও সে যুগ থেকে এ যুগ, সে কাল থেকে এ কালের কতশত দূর্ভাগা থেকে যায় যারা সত্যের রঙে রঙিন হতে চায় না, জেনেও বুঝতে চায় না, নিজের ইচ্ছের গোলামির জিঞ্জির ভেঙে এক আল্লাহর ভারসাম্যপূর্ণ ত্রুটিহীন ইচ্ছেকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারে না। এ দায় কার? সত্যের? সত্যের বার্তাবাহকের? নাকি চারিত্রিক দৃঢ়তাহীন পশুত্বের খোলসে আবৃত বস্তুবাদী সত্তার খাঁচায় বন্দী মানুষদের? প্রাণপ্রিয় রাসূল সা. এর বিশ্বাসী উম্মাত হিসেবে আজ আমাদেরই বা কী করা উচিত ছিল?


এ জবাব আছে বইয়ের পাতায় পাতায়।


বইয়ের শেষ পাতায় একটা চিঠি আছে। ভেবেছিলাম, চিঠিটাও তুলে দেব। তারপর ভাবলাম পাঠক হিসেবে আপনি বইয়ের পুর্ণ স্বাদটা অনুভব করতে পারবেন না। তাই আর দিলাম না। তবে সমাপ্তির আলোচনায় যখন চলেই এসেছি তখন বলে যাই, বইয়ের শেষটুকু ভীষণ অন্যরকম। শেষ করার পর অন্তরাত্মায় যে ধাক্কা অনুভব করেছি তার রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছি না। বইয়ের শেষ অবধি যাবেন প্লিজ!


হৃদয় কুমার আর ভাইয়া চরিত্র যে একেবারেই ভিন্নরকম আর শক্তিশালী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হৃদয়ের অনুসন্ধিৎসু মন, সত্যকে খুঁজে পাবার তুমুল আগ্রহ আর সত্যকে গ্রহণ করে নেবার মতো প্রস্তুত মন দেখে একটা কথাই মনে হয়েছিল, দুনিয়ার আনাচে-কানাচেতে আজও সত্যকে খুঁজে ফিরছে অনেকেই। আমার আপনার আশপাশেই হয়তো। বইয়ের ভাইয়ার মতো আমরাও কি তাদের প্রতি হাত বাড়াই? কাছে টেনে নিয়ে দেখিয়ে দেই সিরাত্বল মুস্তাকীমের পথ? চিনিয়ে দেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ মহানবী সা.কে?


হৃদয়ের একটা কথা খুব ভালো লেগেছে। তুলি ধরছি:


‘মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে যদি সত্যটাকে নিজের লাইফে প্রতিষ্ঠিতই করতে না পারি, তাহলে তো আমি মানুষ হিসেবেই ফাংশনাল হতে পারব না। গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়ালের সাথে নিজের বুদ্ধিমত্তার তুলনা করলে তখন চিংড়ি মাছের চাইতে আমার খুলিতে বেশি ব্রেইন আছে বলে ভাবতে পারব না। আর ভাবতে পারলেও কাজকর্মের কারণে সব প্রমাণ যে তার বিপক্ষে যাবে, তখন আর এত শিক্ষা-দীক্ষা আর সার্টিফিকেটের অর্থ কী? আত্মমর্যাদার স্থান কোথায়?’


হৃদয় কুমারের ভাইয়ার আরেকটা কথা বারবার মনে পড়ছে।


‘মানুষ সত্যকে মানতে পারে না, কারণ সত্য সবসময়েই জীবনকে আমূল বদলে দেয় চড়া দামের বিনিময়ে। হয় সেই সত্যকে গ্রহণ করার কারণে এই জীবনটা দূর্গম-অসহ্য হয়ে আসে পারিপার্শ্বিক সব অনিয়মের ভীড়ে, দুঃশাসনের অত্যাচারে, অথবা এই সত্যকে ত্যাগ করে পরবর্তী জীবনকে পুরোপুরি বিষাক্ত আর ধ্বংস করে রক্তাক্ত করবার দায়িত্বটা যে নিজের হাতেই তুলে নিতে হয়। যে সত্য এমন চড়ামূল্য দাবি করে বসে জীবনের কাছে, সেই সত্যের বাহককে যে নির্মম অত্যাচারে রক্তাক্ত হতেই হবে! আর সেটাই আমরা বারবার সত্যি হয়ে উঠতে দেখি রাসূল সা. এর জীবনে।’


বইয়ের পৃষ্ঠাসজ্জা, বাঁধাই সবকিছুই সুন্দর ছিল। আর লেখকের লিখনশৈলীর ব্যাপারে আগেও বলেছি। বইয়ের একেকটা লাইন আপনার চিন্তার জগতে ঝড় তোলার জন্য যথেষ্ট। দু'আ করি, রব্ব যেন আমাকেও এরকম শক্তিশালী লেখনী দান করেন৷


আল্লাহ তা'আলা লেখকের উপর রহম করুন। বইয়ের সাথে সম্পৃক্ত সকলের কুরবানি কবুল করে নিন। আমাদের ইলমে বারাকাহ দিন। আ-মিন।


ও হ্যাঁ, বইটা কিন্তু আমাকে-আপনাকে উৎসর্গ করেই লেখা। রাসূল সা.কে নিয়ে লেখা আপনাকে উৎসর্গকৃত বইটা পড়বেন না?


Pdf will be uploaded soon


Post a Comment

0 Comments