বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতা উত্তর শাসনামল অনেক বিতর্কিত একটা অধ্যায়। একের পর এক শাসক পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। নতুন রাষ্ট্রে শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছু ঠিক রাখতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন কিন্তু কোনোভাবেই যেন ঠিকভাবে দেশ চলছিল না। গুম, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, রক্ষীবাহিনী, গণবাহিনী, লালবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন করা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ের ইতিহাসকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন পিনাকী ভট্টাচার্য।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই বিতর্কিত ইতিহাস রয়েছে। এর কারণ যারা ইতিহাস লিখে গিয়েছেন তারা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের কিংবা নিজ দলের গা বাঁচিয়ে লিখেছেন। এই বইতে মূলত একটি নির্দিষ্ট ঘরানার বয়ান পাওয়া যাবে। ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ লেখক করেন নি। এতে কিন্তু লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। সহজ, সাবলীল বর্ননার মাধ্যমে লেখক আমাদের ইতিহাসের অন্ধকার দিকগুলোর উল্লেখ করেছেন। লেখকের বিদ্বেষ মোটামুটি বোঝা যায় আওয়ামীলীগ এবং এর সমর্থনকারী গোষ্ঠীর প্রতি। তবে বিদ্বেষটাই ত সব না। এর মাঝে সত্য ইতিহাসও রয়েছে। এতকিছু ঘেটে স্বাধীনতার এত বছর পর এভাবে ইতিহাসের বর্ননার কৃতিত্ব ত দেওয়াই যায়।
বাংলাদেশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর নাম। কিন্তু যুদ্ধোত্তর ও পূর্ব সময়ে বঙ্গবন্ধু কি আলাদা ব্যক্তি ছিলেন না? যুদ্ধের আগে তিনি একজন নেতা হিসেবে সম্মুখে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের পরে যখন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দাঁড়ালেন তখন তাঁর কান ভারী করার লোকের অভাব ছিল না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং প্রশাসন চালানোয় অনভিজ্ঞতার কারণে চাইলেও দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। একইসাথে আওয়ামীলীগের দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের দমনেও তেমন কঠোর পদক্ষেপ তিনি নিতে পারেন নি। এই পদক্ষেপ নিতে না পারার ব্যাপারগুলোই অপরাধীদের উস্কানি দিয়েছে। রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনী দ্বারা বিরোধীপক্ষকে দমন করার প্রক্রিয়াটাও ছিল সমালোচনার বিষয়। সিরাজ শিকদারের হত্যাকাণ্ড, জহির রায়হানের অন্তর্ধান পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর প্রতিক্রিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড, নির্বাচনে কারচুপি, বাকশাল ইত্যাদি বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে বিতর্কিত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী দল হিসেবে আওয়ামিলীগ অবশ্যই প্রধান ভূমিকায় থাকার দাবিদার। কিন্তু যুদ্ধে ত অন্যান্য দলগুলোও অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধের পরে তাদের একেবারে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়াটা বিদ্বেষ তৈরি করেছে। একইসাথে বঙ্গবন্ধুকে এমন এক উচ্চতায় তোলা হয়েছিল, যা আওয়ামীলীগেরই ভেতরে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছিল। ফল হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে জাসদের উত্থান ঘটে। জাসদ ত আওয়ামীলীগের ভেতর থেকেই সৃষ্টি। জাসদের হঠকারিতা এবং সশস্ত্র কর্মকাণ্ড সরকারকে তাদের উপর ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। জাসদের অনেক নেতা-কর্মী নিহত হয়েছে রক্ষীবাহিনীর হাতে। একইভাবে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরাও গণবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে ব্যক্তিগত আক্রোশ, রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের প্ররোচনা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা কাজ করেছিল। ইতিহাসই আমাদের ভবিষ্যতের গতিপথ ঠিক করে দিবে। অথচ আমাদের ইতিহাসই অন্ধকারাচ্ছন্ন।
লেখক বিভিন্ন বই থেকে তথ্য সাজিয়ে উপস্থাপন করেছেন। বইটা পড়লে মনে হবে ঐ সময়টা একেবারেই খারাপ ছিল, ভালো কিছু ছিল না। একপাক্ষিক বর্ননা ছিল, বিশ্লেষণ নেই ঘটনাগুলোর। তবে এই বর্ননার মাঝেও যে অনেক সত্য আছে, এটা স্বাভাবিক। বইটিকে কেউ ব্যবচ্ছেদ করলে এবং ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে বিষয়গুলো আরো স্পষ্ট হবে। শুধু এই বই পড়েই সিদ্ধান্তে আসা উচিৎ হবেনা। হ্যাপি রিডিং।
বইটির পিডিএফ লিংক
একটি ড্রাইভ লিংক বাকি দুটো ফাঁকা
0 Comments