শিয়া ও সুন্নি বিভেদের ইতিহাস বেশ পুরানো। অন্য অনেকের মতো আমারও শিয়াদের সম্পর্কে ভাসাভাসা জানা ছিলো, আবার তাদের প্রতি একটু সহানুভূতিও ছিলো, মনে অনেক প্রশ্ন ছিলো আহলে বায়েত সংক্রান্ত।
শিয়া সম্পর্কে জানার কৌতুহল থেকে গত দুবছর থেকে অল্প অল্প করে জানার চেষ্টা চলছিলো কিন্তু একটি বইয়ের মধ্যে সংক্ষেপে এবং সহজ ভাষায় শিয়া উৎপত্তির ইতিহাস ও বর্তমান সময় পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন, যার লেখক হচ্ছেন মিশরের বিশিষ্ট ইসলাম-প্রচারক, ইতিহাসবিদ ও একজন আধুনিক আরব লেখক ড. রাগেব আস-সারজানী।
যারা ড. রাগেব সারজানি লেখার সাথে পরিচিত আছেন তারা অবশ্যই স্বীকার করবেন যে তিনি তার বইগুলোতে তথ্যের উপস্থাপনা ও বিশ্লেষন দিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাসে জানার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন।
এই নিয়ে বইটি দ্বিতীয়বার পড়া শেষ করলাম। যদিও শিয়া-সুন্নি বিভেদ অস্বস্থিকর, তাই এই সংক্রান্ত আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তারপরও কৌতুহলকে দমিয়ে রাখার সাধ্য কার। প্রথমবার বইটি পড়ে তেমন বুঝে আসেনি তাই কয়েক মাসের ব্যবধানে আবার শুরু করলাম।
আমি বইটি থেকে সংক্ষেপে কিছু বিষয় সকলের সাথে এখানে উপস্থাপন করছি, যারা আরো জানতে ইচ্ছুক তাদের বইটি সংগ্রহ করে পড়া উচিত।
যায়েদী মাযহাব:
হযরত যায়েদ ইবনে আলী যাইনুল আবিদীন ইবনে হুসাইন রা. এর অনুসারীবৃন্দ তার মতবাদ এর উপর ভিত্তি করে একটি মাযহাবের গোড়াপত্তন ঘটায় যেটি যায়েদিয়া মাযহাব নামে পরিচিত। এই মাযহাবটিতে হযরত আলী রা. কে তিন খলিফার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়ার মতবাদ ব্যতীত সর্বক্ষেত্রেই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের সাথে পুরোপুরি একমত পোষণ করে।
রাফেজী মতবাদের সৃষ্টি:
একবার যায়েদ ইবনে আলী রহ. এর ভক্তদের মাঝে একদল তাঁর কাছে হযরত আবু বকর রা. ও ওমর রা. এর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি তাঁদের উপর আল্লাহর রহমাত কামনা করে দুয়া করেন। এতে এই উগ্র দলটি হযরত যায়েদ ইবনে আলী রহ এর তাদের প্রতি রহমত কামনার দুআকে প্রত্যাখ্যান করে তার দল থেকে বেরিয়ে যায়। ইতিহাসে তাদেরকেই ‘ রাফেজাহ’ বা রাফেজি বলা হয়। কেননা একদিকে তারা হযরত আবু বকর রা. ও ওমর রা. এর ইমামত কে অস্বীকার করেছে আরেক দিকে যায়েদ ইবনে আলী রহ. এর মতামতটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এর এই রাফেজী দলটি থেকেই শীয়াদের সর্ববৃহৎ ‘ইছনা আশারিয়া’ দলটির উৎপত্তি।
ইসমাঈলা সম্প্রদায়:
মায়মূন আল-কাদ্দাহ নামের এক কট্টর ইহুদি মুসলিম সেজে মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে জা’ফর সাদেকের ঘনিষ্ট হয়ে তার সাহচর্য গ্রহণ করেন। এই লোকটি এক অদ্ভুদ কাজ করেছিলো। তার এক ছেলের নাম রেখেছিলো আব্দুল্লাহ সেই সাথে সে মৃত্যুর পূর্বে অসিয়ত করে যায় যে, তার সন্তানাদি ও নাতিদের নাম হুবহু মাহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈলের সন্তানাদি ও নাতীদের নামের সাথে মিল রেখে রাখা হয়। যাতে ইতিহাসের কোন এক স্তরে গিয়ে এ সমস্ত ইহুদীরা দাবি করে বসবে যে, তাদের বংশধারা আহলে বাইত বা নবী বংশের সাথে সম্পর্কিত। তার উদ্দেশ্য সফল হয়, সৃষ্টি হয় ইসমাঈলিয়া সম্প্রদায়।
কারামিতা সম্প্রদায়:
শীয়াদের মধ্যে আরেকটি চরমপন্থি গ্রুপ ছিলো যারা অন্যান্য শীয়া দল থেকে সবচেয়ে নিষ্ঠুর, দাঙ্গাবাজ ও সহিংস ছিলো। তারা সবচেয়ে বড় অঘটন যেটি ঘটিয়েছিলো তা হলো ৩১৭ হিজরীতে মসজিদে হারামের উপর হামলা করে সমস্যা হাজীদের হত্যা করে এবং পবিত্র হাজরে আসওয়াদকে লুট করে নিয়ে যায়, যা উদ্ধার করা হয় ২২ বছর পর ৩৩৯ হিজরিতে।
ইমামত:
ইমাম খোমেনী তার লিখিত কিতাব আল-হুকূমাতুল ইসলামিইয়্যায় উল্লেখ্য করেছেন, ‘ ইমামগণ এমন মর্যাদার স্তরে পৌছে যান যে স্তরে কোন নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা কিংবা প্ররিত নবীও পৌঁছাতে পারে না।’ তাদের মত অনুযায়ী ইমামত অস্বীকারকারী কাফের এবং তাদের হত্যা করা হালাল মনে করে যদিও তারা মুসলিম হউন।
ইরাকের সুন্নী মুসলিম সংগঠন জাবহাত ওলামাউস সুন্নাহ এর মহাসচিব হারেছ আদ-দারী বলেন, ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়টিতে প্রায় একলক্ষ্ সুন্নী মুসলিম হত্যা করা হয়েছে আর বিতারন ও উচ্ছেদ এখনও অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া ইরানে সুন্নী মুসলমানরা খুবেই শোচনিয় অবস্থায় দিনযাপন করে আসছে, তাদের অনকে মসজিদ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ভাবা যায় ইরানের রাজধানি তেহরানে নাকি সু্ন্নিদের কোন মসজিদ তৈরী করার অনুমতিও দেওয়া হয়নি যদিও তারা অনুমতির জন্য অনেক বছর ধরে চেষ্টা করে আসছে। শুধু তাই নয় তাদের প্রজন্মকে ইসনে আশারিয়া আকিদায় পাঠ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
উক্ত বইটিতে বর্তমান সিরিয়ার শাসক গোষ্ঠির অতীত ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। নুছাইরি আলাবি সস্প্রদায়ের হাফেজ আল-আসাদ এর কথাও আলোচনায় এনেছেন যারা হযরত আলী রা. কে খোদা মনে করে থাকে, আর এই আকিদার কারনে তাদেরকে মুসলিম হিসেবে খারিজ করে দিয়েছে তৎকালীন আলেমরা। আরো আলোচনা করা হয়েছে বর্তমান লেবানন ও হিজবুল্লাহ আন্দোলন, হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠাতা মুসা আস-সদর, হাসান নাসুরুল্লাহর কার্যপদ্ধতি, ইয়েমেন ও হুতি আন্দোলন, ইরানের ইমাম এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে।
বাংলাদেশী মুসলিমদের জন্য এই বইটি কি উপকারে আসতে পারে?
আমাদের বাংলাদেশীদের মূল দুর্বলতা হলো জানতে না চাওয়ার আগ্রহ এবং অন্ধ আবেগ নিয়েই জীবন অতিবাহিত করা। যেহেতু বাংলাদেশে শীয়ার সংখ্যা খুবেই কম ফলে প্রভাবও খুবেই কম তারপরও তারা তাদের এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার জন্য বুদ্ধিভিত্তিকভাবে কাজে করে যাচ্ছে কৌশলের সাথে। তারা বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়াতে তাদের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের মনের সাহাবাদের প্রতি বিদ্বেষ গোপন রেখে আহলে বায়েতের নামে সহানুভূতি অর্জনের কাজ করে যাচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছে আর এতোটুকু না পারলেও ইসলামি ধর্মের প্রতি সন্দিহান করে তুলছে । এতে অনেক সুন্নি শিক্ষিত মুসলিমও তাদের যুক্তির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে, এবং ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছে শিয়াদের সম্পর্কে বিস্তারিত না জানার কারনে। আশাকরি বইটি পাঠে এই দেশের শিক্ষিত সচেতন মুসলিমরা আরো সতর্ক হবে।
শিয়াদের সাথে আমাদের আচরন কেমন হওয়া উচিত?
লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী আমাদেরকে শীয়াদের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো দাওয়াত ও অন্তর্নিহিত নসীহত পেশ করতে হবে। যাতে করে তারা খাঁটি ইলমি গবেষনায় লিপ্ত হয়ে ও পাঠ করে দেখে তাদের ইতিহাস আর আকীদার আদ্যপান্ত……….। আশা করা যায় শীয়াদের মধ্যে যারা মুখলিছ, খাঁটি হৃদয়ের অধিকারী তারা তাদের ত্রুটিগুলো দেখার পর অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে, দিশা পাবেন সঠিক পথের। আর এমন তাওফিক দান করা আল্লাহর জন্য কঠিন কিছুই নয়।
যারা আরো জানতে আগ্রহী তাদেরকে বইটি পাঠের আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকের মতো সমাপ্ত করছি।
বইটির পিডিএফ লিংক
একটি ড্রাইভ লিংক বাকি দুটো ফাঁকা
0 Comments