জানাযা নামাজের নিয়ম, নিয়ত, দোয়া


 'প্রত্যেক প্রাণীকে অবশ্যই মৃত্যর স্বাদ গ্রহণ কতে হবে৷' (সূরা, আলে ইমরান, আয়াত ১১৫)


মানুষ মরণশীল৷ পৃথিবীর শুরু থেকেই প্রতিটি মানুষ একে একে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করে আসছে৷ সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর বিপরীতে চলে যায় ধূসর হয়ে হয়ে একজোড়া চোখের বৃদ্ধ মানুষটি৷ অল্পবয়সে চলে যায় স্বপ্নবাজ যুবক-যুবতী৷ বাদ যায়না কিশোর-কিশোরী, শিশু, ভ্রুণও৷ 

মৃতু্কে শেষ বিদায়ের জন্য রয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় নির্দেশনা৷ যা জানাযায় নামাজ হিসেবে পরিচিত৷ ফিকহ মতে, একজন মুসলিম অর্থাৎ ইসলাম ধর্মামলম্বীর জন্য এটি ফরযে কেফায়া বা সমাজের জন্য আবশ্যকীয় দায়িত্ব, অর্থাৎ কোনো মুসলীমের মৃত্যু হলে মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে অবশ্যই জানাযার নামাজ আদায় করতে হবে। তবে কোনো এলাকা বা গোত্রের পক্ষ থেকে একজন আদায় করলে সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায়। 

এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, 

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আমি বলতে শুনেছি যে, এক মুসলিমের প্রতি অপর মুসলিমের হক পাঁচটি, যথাঃ ১. সালাম দিলে কার জবাব দেওয়া, ২. অসুস্থ হলে তীর খোঁজ-খবর নেওয়া, ৩. জানাযার নামাজে উপস্থিত হওয়া, ৪. দাওয়াত দিলে তা কবুল করা এবং ৫. হাঁচিদাতার জন্য দোয়া করা।' (ই.ফা: ১১৬৮)

অপর একটি হাদীসে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন,

'কোন মৃত ব্যক্তির জানাজায় যদি শিরক না করা ৪০ জন ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে নামাজ আদায় করে, তবে মৃত ব্যক্তির ব্যাপারে তাদের সুপারিশ, দোয়া আল্লাহ কবুল করে নেবেন৷' (সহীহ মুসলিম) 

জানাজার নামাজের সুন্নত পদ্ধতী হচ্ছে, লাশকে কিবলার দিক করে রাখতে হবে। পুরুষের লাশ হলে মাথার পাশ বরাবর ইমাম সাহেব দাঁড়াবেন। আর যদি নারী হয় তবে মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়াবেন৷ 

জানাযার নামাজ:

জানাজার নামাজ পুরুষ ইমাম বা ওছীয়তকৃত ব্যক্তির দ্বারা আদায় করতে হয়৷ সাধারণত মসজিদের মাঠে জামাতবদ্ধভাবে জানাজার নামাজ পড়া হয়৷ তবে জানাজায় অনেক লোকের উপস্থিত হবার সম্ভাবনা থাকলে মাঠে বা উন্মুক্ত স্থানেও আদায় করা যাবে৷ এ নামাজে কাতার হতে হবে বেজোর সংখ্যায়৷ এটি ৪ তকবিরের নামাজ। দাঁড়িয়ে এ নামাজ আদায় করতে হয় এবং সালাম ফেরানোর মধ্য দিয়ে এ নামায শেষ হয়। জানাযার নামাযের শেষে মুনাজাত বা দোয়া করার প্রয়োজনীয়তা নেই, কেননা এ নামাজের মধ্যেই মৃতের জন্য আরবীতে দোয়া করা হয়ে থাকে৷ জানাযা শেষে মৃতব্যক্তিকে সরাসরি কবরস্থানে নিয়ে যেতে হবে এবং ধর্মীয় নির্দেশনা অনুযায়ী কবর তৈরি করে তাতে দাফন করতে হবে।

জানাযার নামাজের নিয়ম:

ইমামের পেছনে চার তাকবীরের সহীত জানাযার নামাজ আদায় করতে হয়। ঈদের নামাজে তাকবীর দেয়ার সময় দুই হাত কান পর্যন্ত তুলতে হয়, কিন্তু জানাযার নামাজে ইমাম তাকবীর দেয়ার সময় হাত কোনরকম তোলার প্রয়োজন নেই। দুই পাশে হাত ছেড়ে দাড়িয়ে থাকলেই হবে৷

আরও পডুন: জীবিকার খোঁজে pdf download

জানাযার নামাজের নিয়ত:

نَوَيْتُ اَنْ اُؤَدِّىَ لِلَّهِ تَعَا لَى اَرْبَعَ تَكْبِيْرَاتِ صَلَوةِ الْجَنَا زَةِ فَرْضَ الْكِفَايَةِ وَالثَّنَا ءُ لِلَّهِ تَعَا لَى وَالصَّلَوةُ عَلَى النَّبِىِّ وَالدُّعَا ءُلِهَذَا الْمَيِّتِ اِقْتِدَتُ بِهَذَا الاِْمَامِ مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِ يْفَةِ اَللَّهُ اَكْبَرُ

নিয়তের বাংলা উচ্চারণ: "নাওয়াইতু-আন-উয়াদ্দিয়া লিল্লাহে তাআ'লা আরবা-আ-তাকবীরাতে ছালাতিল জানাজাতে ফারজুল কেফায়াতে আচ্ছানাউ লিল্লাহি তাআ'লা ওয়াচ্ছালাতু আলান্নাবীয়্যে ওয়াদ্দোয়াউ লেহাযাল মাইয়্যেতে এক্কতেদায়িতু বিহাযাল ইমাম মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতে আললাহু আকবার।"

নিয়তে উল্লেখিত ‘লেহাযাল মাইয়্যেতে’ পুরুষ/ছেলের জানাজায় পড়তে হবে, আর নারী/মেয়ে হলে ‘লেহাযিহিল মাইয়্যেতে’ বলতে হবে।

নিয়ত আরবিতে করতে না পারলে বাংলায় করলেও চলবে, ‘আমি চার তাকবিরের সহিত ফরজে কিফায়া জানাযার নামাজ কিবলামুখী হয়ে ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে মরহুম ব্যক্তির (পুরুষ/মহিলার) জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যে আদায় করছি। আল্লাহু আকবার।’

জানাযার নামাজে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও রাসূলের ওপর দরুদ পাঠ করা হয়। বাংলায় নিয়ত করলে তা বাংলায় বলে অথবা মনে মনে নিয়তে আনলেও চলবে।

নিয়তে তাকবীরে তাহরিমা অর্থাৎ, ইমাম আল্লাহু আকবার বলার পর হাত তুলে তারপর অন্যান্য নামাজের মতো হাত বেঁধে নিতে হবে। হাত বেধে ঠোট নাড়িয়ে সানা পড়তে হবে।

আরবিতে সানা : 

سُبْحَا نَكَ اَللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَا لَى جَدُّكَ وَجَلَّ ثَنَاءُكَ وَلاَ اِلَهَ غَيْرُكَ

বাংলা উচ্চারণ :

সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারা কাসমুকা, ওয়া তাআলা জাদ্দুকা, ওয়া জাল্লা ছানাউকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।

সানা পড়ার পরে তাকবীর (আল্লাহু আকবার) বলে দরুদ শরীফ পড়তে হবে যেটা সাধারণ নামাজে তাশাহুদের পর পড়া হয়।

দরুদ শরীফ:

للَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى اَلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى اِبْرَا هِيْمَ وَعَلَى اَلِ اِبْرَ اهِيْمَ اِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ- اَللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى اَلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى اِبْرَا هِيْمَ وَعَلَى اَلِ اِبْرَا هِيْمَ اِنَّكَ حَمِيْدٌمَّجِيْدٌ

বাংলা উচ্চারণ :

আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদি ওয়া আলা আলি মুম্মাদিন কামা সাল্লাইতা আলা ইব্রাহিমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহিমা ইন্নাকা হামিদুম্মাজীদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইব্রাহিমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহিমা ইন্নাকা হামীদুম্মাজীদ।

দরুদ শরীফ পড়ার পর তৃতীয় তাকবীর (আল্লাহু আকবার) আদায় করে জানাযার দোয়া পড়তে হয়।

জানাযার নামাজের দোয়া 

لَّهُمَّ اغْفِرْلحَيِّنَاوَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيْرِنَا وَكَبِيْرِنَا وَذَكَرِنَا وَاُنْثَا نَا اَللَّهُمَّ مَنْ اَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَاَحْيِهِ عَلَى الاِسْلاَمِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الاْيمَانِ بِرَحْمَتِكَ يَا ارْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ

বাংলা উচ্চারণ : 

আল্লাহুম্মাগফিরলি হাইয়্যেনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িইবিনা ও ছাগীরিনা ও কাবীরিনা ও যাকারিনা ও উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলামী ওয়া মান তাওয়াফ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফ ফাহু আলাল ঈমান বেরাহমাতিকা ইয়া আর হামার রাহীমিন।

 নাবালক ছেলের ক্ষেত্রে জানাযার দোয়া :

اَللَّهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرْطًا وْاَجْعَلْهُ لَنَا اَجْرًا وَذُخْرًا وَاجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا وَمُشَفَّعًا

বাংলা উচ্চারণ : 

আল্লাহুম্মাজ আল হুলানা ফারতাও ওয়াজ আল হুলানা আজরাও ওয়া যুখরাঁও ওয়াজ আলহুলানা শাফিয়াও ওয়া মুশাফ্ফায়ান।

নাবালিকা মেয়ের ক্ষেত্রে জানাযার দোয়া

اللَّهُمَّ اجْعَلْهَا لَنَا فَرْطًا وَاجْعَلْهَا لَنَا اَجْرًا وَذُخْرًاوَاجْعَلْهَا لَنَا شَافِعَةً وَمُشَفَّعَة

বাংলা উচ্চারণ : 

আল্লাহুম্মাজ আলহা লানা ফারতাও ওয়াজ আলহা লানা আজরাও ওয়া যুখরাও ওয়াজ আলহা লানা শাফিয়াও ওয়া মুশাফ ফায়ান।

এরপর চতুর্থ তাকবীর দিয়ে একটু নীরব থেকে ডানে এবং বামে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করতে হবে।

জানাজার নামাজে উপস্থিত হতে দেরি হলে যে অবস্থায় জামাতকে পাওয়া যাবে সেভাবেই নামাজ পরতে হবে৷ ইমাম সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামাজ শেষ করলে মাসবুক অর্থাত্ পরে উপস্থিত হওয়া ব্যক্তিও ইমামের সাথে সালাম ফিরাবে৷ একাকী জানাজা পরার বিধান নেই৷ 

জানাযার নামাজের ফজিলত: 

এ  নামাজ ফরজে কেফায়া হওয়ার কারণে জানাজার নামাজ সমাজের কিছু মানুষ আদায় করলে অন্যরা দায়মুক্ত হওয়া যাবে। তবে, কেউ আদায় না করলে একসঙ্গে সমাজের সকলে পাপের ভাগীদার হবে। সমস্যা থাকলে বা গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলে একি এলাকার অন্য কেউ নামাজ পড়লে গুনাহগার হবে না।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীস, হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'নিশ্চয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো মৃত মুসলিম ব্যক্তির জানাযায় ঈমান সহকারে ও ছাওয়াবের আশায় শরিক হয় এবং জানাযা ও সমাধি পর্যন্ত থাকে, সে দুই কিরাত নেকি পাবে। প্রতি কিরাত হচ্ছে ওহুদ পাহাড়ের সমান। আর যে জানাযা পড়ে দাফনের পূর্বে ফিরে যাবে, সে এক কিরাত নেকি নিয়ে ফিরবে।' 

- সূত্র: বুখারী, ‘জানাযা’ অধ্যায়, হা/১৩১৩২৭; মুসলিম, ‘জানাযা’ অধ্যায়, হা/৯৫১

তাই মুসলিম হিসেবে দায়িত্ব পালনই কেবল নয়; বরং সওয়াব লাভের সুযোগ হিসেবেও বিবেচনা করা প্রয়োজন৷ নিজের মৃত্য পরবর্তী জানাজার কথা চিন্তা করেও নিজে আদায় ও অপরকে উৎসাহিত করতে হবে৷ 


Post a Comment

1 Comments

  1. জানাজার নামাজে সানা হিসাবে সুরা ফাতিহা পড়তে হবে - এটাই সঠিক।
    দোয়া সানা পড়ার কোনো হাদিস নেই।

    ReplyDelete